টিসিসি : পর্যটনগন্তব্যগুলো ধ্বংস বা রক্ষা করার সময় এখনই

Share on Facebook

বাংলাদেশের পর্যটনৈতিক সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে বাস্তব প্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করার সময় এসেছে। যৌক্তিক দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে অচিরেই পর্যটন অনিবার্য সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। একথা অস্বীকার করা অনুচিত যে পর্যটনের সম্ভাবনা এখনো সম্ভাবনাই থেকে গেছে। এই সম্ভাবনাকে পূঁজি করে পর্যটনকে যতদূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব ছিলো তা হয়নি। দেশের পর্যটনগন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে উল্লেখযোগ্যভাবে বাজারজাত করা যায়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশীয় পর্যটকের অতিরিক্ত চাপে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনগন্তব্য ইতোমধ্যে ধ্বংস হওয়ার পথে।

দেশে কতগুলো পর্যটনগন্তব্য আছে, এরমধ্যে কতোগুলোকে বাজারজাত করা হয়েছে, অতিরিক্ত পর্যটকের ভার হতে কোন কোন পর্যটনগন্তব্যগুলো রক্ষা করতে হবে, কোন কোন পর্যটগন্তব্যগুলোতে পরিকল্পিতভাবে আরও পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য সাজাতে হবে ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এখনি।

সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড় ও কুয়াকাটাসহ অনেকগুলো পর্যটনগন্তব্য আছে যেগুলো সামর্থ্যানুযায়ী এখনো ব্যবহার করা হয়নি। অন্যদিকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য ইতিমধ্যে অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে ধ্বংসের পথে। এক্ষেত্রে সবার আগে আসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কথা। অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ দ্বিপটি ধ্বংস হবার পথে। অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে আরেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনগন্তব্য বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সুন্দরবনও ভালো নেই। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক আর হোটেলের জঙ্গলের কারণে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনগন্তব্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নীরব ক্ষয়রোগের কথাও যথাযথ জায়গা থেকে উঠছেনা।পর্যটকের চাপ যেভাবে বাড়ছে তাতে বান্দরবান, রাংগামাটিসহ অনেক জনপ্রিয় পর্যটনগন্তব্যরই ভবিষ্যত প্রশ্নোবধক ।

পর্যটনগন্তব্যগুলোর পর্যটক ধারণক্ষমতা নির্ধারণ জরুরী। যেহেতু এখন পর্যন্ত দেশের কোনো পর্যটনগন্তব্যেরই পর্যটক ধারণক্ষমতা (টিসিসি বা ট্যুরিস্ট ক্যারিং ক্যাপাসিটি) নির্ধারণ করা হয়নি। তাই ট্যুর অপারেটর ও পর্যটকরা জানেন না কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কতসংখ্যক পর্যটক ধারণ করতে পারবে। গন্তব্যগুলোর সাধারণ অবকাঠামো ও পর্যটন অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন হয়েছে তা উন্নয়ন বা অবনয়ন- এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেমন: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে কতটুকু দূরে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট বা গেস্ট হাউজ গড়ে তোলা উচিত সেগুলো দেখভাল করার জন্য কোনো কতৃপক্ষ আছে কি-না? থাকলে তাঁরা নজরদারি করছে কি-না? তাদের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা আছে কি-না এমন অনেক প্রশ্ন সামনে আসে।

পর্যটন নিয়ে দেশে কত আলোচনা, কত কত বিশাল আয়োজন। অথচ গবেষণা নেই। গবেষণার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা নেই কোন পর্যটনগন্তব্যে কোন ধরণের হোটেল মোটেল বা গেস্ট হাউজ গড়ে তুলতে হবে। বান্দরবান শহরের মতো করে পাহাড়ের মধ্যে ইট পাথরের অবকাঠামো গড়ে তোলা ঠিক হবে কিনা, আবাসিক হোটেল মোটেল করতে গিয়ে পাহাড় কাটা যাবে কিনা, গাছ-কাটা যাবে কি-না, গেলে তা কতটুকু- এগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভেতর আনতে হবে।

ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা পর্যটনগন্তব্যগুলোর বিকল্প গন্তব্য গড়ে তোলাও জরুরী। দেশের হাওর বাওর বা নদীনালা কেন্দ্রীক পর্যটন গড়ে তোলার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃতি ও ঋতুভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনাও কম নয়। বর্ষা উপভোগ নিয়েই গড়ে তোলা সম্ভব বর্ষাকালীন পর্যটন। এছাড়া হাওর এবং চলনবিলের মত বিলগুলোকে কেন্দ্র করেও পর্যটনগন্তব গড়ে তোলা যায়। পরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন পর্যটনগন্তব্য গড়ে তোলা এবং জনপ্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের এখনই সময়। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই যে, দেশের প্রতিষ্ঠিত, পুরাতন ও নতুন সকল পর্যটনগন্তব্যকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি পর্যটনগন্তব্যে কত সংখ্যক পর্যটক ধারণে সক্ষম/ক্যাপাবেল তা নির্ধারণ করে নির্ধারন করে পর্যটনকর্ম বাস্তবায়ন করতে হবে।

বহু রাষ্ট্রই অতিরিক্ত পর্যটকের বোঝা থেকে পর্যটনগন্তব্যগুলো রক্ষা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন থাইল্যান্ডের কিছু দ্বীপে অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটকগমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ড সরকার আমস্টারডামের নিদর্শন ‘আই আমস্টারডাম’ সরিয়ে ফেলেছে। ২০০৬ সাল থেকে বিখ্যাত রাইকজ মিউজিয়ামের বাইরে রাখা হয়েছিল ছয় ফুট লম্বা ‘আই আমস্টারডাম’ নিদর্শনটি। সেই থেকে নয়নাভিরাম আমস্টারডামের অন্যতম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই নিদর্শনটি। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো আমস্টারডাম। তাই শহরটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটক আকর্ষণ ‘আই আমস্টারডাম’ সরানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাচ সরকার। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের শেষে আমস্টারডামে পর্যটকের সংখ্যা ছাড়াবে ২ কোটির ঘর।

অতিরিক্ত পর্যটকের ভার নিয়ে শুধু উন্নত বা পর্যটনকেন্দ্রিক দেশগুলোই শুধু ভাবছে না, ভাবছে সচেতন প্রতিটি রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীরব থাকার বা সময়ক্ষেপণের উপায় নেই। পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং পর্যটনগন্তব্যগুলো রক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্যারিং ক্যাপাসিটি/ধারণসক্ষমতা নির্ধারণ জরুরী। অন্যথায় পর্যটনের অসম্ভব সম্ভাবনার স্বপ্নটি সম্ভব না হয়ে অসম্ভবই রয়ে যাবে।

 আবু রায়হান সরকার, সম্পাদক, পর্যটনিয়া।

Leave a Reply